
কাজী নজরুল ইসলাম দুর্বার বেগে এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন জরা ও জীর্ণকে। আমাদের ম্রিয়মাণ মনের অঙ্গনকে সজীব করে তুললেন তাঁর তরতাজা সতেজ সব গান ও কবিতা দিয়ে। নতুনের বার্তাবাহক নতুন মানুষ তিনি যিনি কোনো বন্ধন মানেন না। বেড়া ভাঙার গান গেয়েছেন তিনি। মনুষ্যত্বের জয়গান তার কণ্ঠে। তিনি তো জয় করবেনই জাতির নবীনতার প্রত্যাশীদের। হলোও তাই। সেই আমলের বাংলার তরুণ-সমাজের মুকুটহীন সম্রাট হয়ে গেলেন নজরুল। সংস্কৃতির অঙ্গনের নতুন কাণ্ডারী তিনি। এ ইতিহাস আমাদের জানা।
নজরুলের শ্রেষ্ঠ কীর্তিই হচ্ছে তাঁর গান। বাংলা গানকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের মতন তিনিও বাংলা গানে বিশ্বসুরের মূর্তি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার গানের সুর চয়ন করে বাংলা গানের সুরের সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন তিনি। সুরের জগতে এ এক বিপ্লব। ১৯৪৪ সালে বুদ্ধদেব বসু ’কবিতা' পত্রিকার বিশেষ নজরুল সংখ্যা প্ৰকাশ করেন । ‘কবিতা’ পত্রিকার তখন দশম বর্ষ চলছে। বাংলা পত্রিকার সর্বপ্রথম নজরুল সংখ্যা। এই সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু তার প্ৰবন্ধে বলেন, ‘গানের ক্ষেত্রে নজরুল নিজেকে সবচেয়ে বেশি করে দিতে পেরেছেন। তাঁর সমগ্র রচনাবলীর মধ্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তার গানের। বীর্যব্যঞ্জক গানে- চলতি ভাষায় যাকে স্বদেশি গান বলে- রবীন্দ্ৰনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের পরই তাঁর স্থান, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু' উৎকর্ষের শিখরস্পর্শী।’. ... ‘নজরুলের সমস্ত গানের মধ্যে যেগুলি ভালো সেগুলি সযত্নে বাছাই করে নিয়ে একটি বই বের করলে সেটাই হবে নজরুল-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয়- সেখানে আমরা যার দেখা পাবো তিনি সত্যিকার কবি, তাঁর মন সংবেদনশীল, সূক্ষ্ম-কোমল, আবেগপ্রবণ উদ্দীপনা পূর্ণ। সে-কবি শুধুই বীররসের নন, আদিরসের পথে তাঁর স্বচ্ছন্দ আনাগোনা, এমনকি হাস্যরসের ক্ষেত্রেও প্রবেশ নিষিদ্ধ নয় তাঁর।’ ... ‘কালের কণ্ঠে গানের মালা তিনি পরিয়ে দিয়েছেন। সে মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়। আর কবিতাতেও তাঁর আসন নিঃশংসয়, কেননা কবিতায় তাঁর আছে শক্তি, আছে স্বচ্ছন্দ, আছে সচ্ছলতা, আর এগুলিই কবিতার আদিগুণ।’
‘কবিতা' পত্রিকার উক্ত সংখ্যায় নজরুলের বন্ধু সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে বলেন, "নজরুলের নিজের রচিত প্ৰথম গান যা সে বন্ধুদের প্রথম শুনিয়েছিল সেটা বোধহয় ‘ওরে আমার পলাতকা’ - তারপর বাঙলা দেশে নজরুল গানের পুষ্পবৃষ্টি করে গেছে। সে নিজে একজন বিশিষ্ট সুরজ্ঞ ছিল, তাই তার গানে সে এমন পরিপূর্ণ প্রাণসঞ্চার করতে পেরেছে। একদিন নজরুলের গানে বাঙলা দেশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তার নব নব সুরের মাধুর্যে ও মূৰ্ছনায়।"
তাই এখনো নিজের অজান্তেই গুনগুনিয়ে উঠি, অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে। প্রদীপ-শিখা-সম কপিছে প্ৰাণ মাম তোমারে, সুন্দর, বন্দিতে।
কবিতার নজরুল
কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর আসল লক্ষ্যই ছিল মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা। এই জন্য তিনি মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। রেনেসাঁস আন্দোলন থেকে পাঠগ্রহণ করেছেন বলেই জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ঐতিহ্যের মিলনসাধনের চেষ্টা তাকে করতে দেখা যায়। তাঁর এই কাজ জরাজীর্ণ সমাজকে নতুন জীবনদান করার কাজ। প্ৰাণবান জাতির স্বপ্ন তিনি আমাদের দেখিয়েছেন। এখানে তিনি তুলনারহিত।
সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ভেঙে তিনি বাংলা কবিতাকে নতুন প্রান্তরে নিয়ে এলেন। নবীন কবিকণ্ঠ খুঁজে পেল নতুন দিশা। জীবনবাদী কবিতায় বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠল মুখর। রবীন্দ্ৰপ্ৰভাব এড়িয়ে নতুন ধরনের কবিতা লেখার ভাবনায় যারা ভাবিত তাদের অন্যতম পুরোধা হয়ে উঠলেন কবি নজরুল। গানে ও কবিতায় বৈচিত্র্যের সমারোহ এনে নতুন প্রাণসঞ্চার করাই তখনকার তার নেতৃত্ব।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তৎকালীন তরুণ বুধমণ্ডলীর একজন নিবেদিতপ্রাণ সদস্য। নজরুলের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছিলেন। তাই ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের জবানী তিনি তুলে ধরেছেন। এইভাবে;
...সন্দেহ কি, শুধু ‘বিদ্রোহী'র কবি নয়, কবি-বিদ্রোহী। তার কণ্ঠস্বরে প্রাণবন্ত প্রবল পৌরুষ, হৃদস্পন্দী আনন্দের উত্তালতা। গ্রীস্মের রুক্ষ আকাশে যেন মনোহর ঝড় হঠাত ছুটি পেয়েছে। কর্কশের মাঝে মধুরের অবতারণা। নিজের অলক্ষ্যে কখন ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে নৃপেন। সমস্ত কুন্ঠার কালিমা নজরুলের গানে মুছে গেছে। ... নজরুলের চোখ পড়ল নবীন বন্ধুতার। ...নজরুল বললে, ‘ধূমকেতু’ নামে এক সাপ্তাহিক বের করছি। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি মহাকালের তৃতীয় নয়ন, আপনি ত্রিশূল। আসুন, দেশের ঘুম ভাঙাই, ভয় ভাঙাই।
নৃপেন উৎসাহে ফুটতে লাগল। বললে, এমন শুভকাজে দেবতার কাছে আশীৰ্বাদ ভিক্ষা করবেন না? তিনি কি চাইবেন মুখ তুলে। তবু নজরুল শেষমূহুর্তে তাঁকে টেলিগ্ৰাম করে দিল। রবীন্দ্রনাথ কবে কাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাছাড়া, এ নজরুল, যার কবিতায় পেয়েছেন তিনি তপ্ত প্ৰাণের নতুন সজীবতা। শুধু নামে আর টেলিগ্রামেই তিনি বুঝতে পারলেন ‘ধূমকেতু’র মর্মকথা কি। যৌবনকে ‘চিরজীবী’ আখ্যা দিয়ে ‘বলাকা’য় তিনি আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে বলেছিলেন, সেটাতে রাজনীতি ছিল না, কিন্তু, এবার 'ধূমকেতু’কে তিনি যা লিখে পাঠালেন তা স্পষ্ট রাজনীতি, প্রত্যক্ষ গণজাগরণের সংকেত।
নবজাগরণের চারণকবি নজরুল । তাই রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল বিষয়ে তার ছিল সজাগ দৃষ্টি। শিল্পবােধ কোথাও কোথাও খর্ব হলেও কবিতা যে জীবনসংগ্রামের হাতিয়ার হতে পারে সে-বোধ বাংলা কবিতার পাঠকেরা তীব্রভাবে পেয়েছে তারই কবিতার মাধ্যমে। পরাধীনতার গ্লানি থকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার যে দৃপ্ত উচ্চারণ তাঁর, তা বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল ইসলামই সবচেয়ে বেশি যৌবনবন্দনা করেছেন আর মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং সমাজের অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এ যেন তারুণ্যকে নতুন করে আবিষ্কার করা। তাঁর কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয়েছে "আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ”। এই উচ্চারণ যেমন তারুণ্যের তেমনি আত্মমহিমা-বোধের। এই আত্মমহিমা-বোধ ব্যতিরেকে ইন্টেলেকচুয়াল হওয়া যায় না। তাই তারুণ্যের সঙ্গে মনীষার খুব মিল। নজরুলের চরিত্রে এই দুই সত্তার মিলন ঘটেছিল বলেই এত বেশি সচেতনতা ও স্পর্ধা তার কবিতায় আমরা পাই । নজরুল আমাদের কাছে যৌবনের প্রতীক।
অসাম্প্রদায়িক নজরুল
এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির আমাদের
দিয়া 'প্ৰহারেণ ধনঞ্জয়'
তাড়াব আমরা, করি না ভয়,
যত পরদেশী দাসু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের।
বাঙলা বাঙালির হোক।
বাঙলার জয় হোক।
বাঙালির জয় হোক।
জীবন অনেক ঘটনা-অঘটনে ভরা। ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গের বেদনায় আহত রবীন্দ্রনাথ জাতির অন্তরে বাউল সুরে ডাক পাঠিয়েছিলেন। “আমার সোনার বাঙলা আমি তােমায় ভালবাসি” বলে। অনতিপরবর্তীকালে পরদেশী (বৃটিশ) শাসন আর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিপক্ষে সবচেয়ে উচ্চ রোলে জাতিকে ডাক দিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ৷৷ ১৩২৯ বঙ্গাব্দে তিনি লিখলেন :
সর্বপ্রথম, "ধূমকেতু” ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতবাসীদের হাতে। … যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মােড়লী করে দেশকে শ্মাশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে।
এই সঙ্গে বাঙলা ও বাঙালি নিয়ে ভাবিত কবি লিখেছেন :
বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে “বাঙালির বাঙলা” সেদিন তারা অসাধ্য সাদন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মত জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম শক্তি এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোন জাতির নেই। কিন্তু কর্মশক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে।
আজো তমসাচ্ছন্ন জাতির কর্মশক্তির উদ্বোধন ঘটাতে “বাঙলার শ্যাম শ্মশানের মায়ানিদ্রিত ভূমে অগ্রদূত তূর্যবাদক” কবি যা কিছু লিখেছিলেন তা-ই বাঙালি জাতির শ্ৰেষ্ঠ সারাৎসার এবং জাতীয়মুক্তির উজ্জ্বলতম দিকনির্দেশনা। এই কবি অন্তরেবাহিরে সর্বব্যাপ্ত করে ডাক দিয়েছিলেন জাতিকে । লিখেছিলেন বিদ্রোহের গান, গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান, ছাত্রদলের গান। বাহিরের এই সাংগঠনিক হাতিয়ার হাতে যারা মুক্তির আলোকবর্তিকা জ্বালবেন তাদের উদ্দেশে বৃটিশ শাসকের উস্কে দেয়া শোষণ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডামাডোল ছাপিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন;
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও' মুখ হইতে কেতাব-গ্ৰন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে!
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনাে,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাঙালি কবি চন্ডিদাস যেমনটি উচ্চারণ করেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ তেমনি বাঙলাভূমের একালের কবি আরেকবার উচ্চারণ করলেন;
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
… তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাৰে সখা খুলে দেখ নিজ প্ৰাণ।
...এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মধুরা,, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ পয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
কিংবা;
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্দীপিত এই পদ্যকারের মৌলিক ধারাপাত পাঠ করেই, জাতীয় বিভাজন-রেখার ভেতরে থেকেই, পরদেশী শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে— 'এক হাতে রণতূর্যে’র কবি নজরুল ছিলেন তার প্রত্যক্ষ প্রেরণা।
সারা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার বারবার মনে পড়ে তাঁরই কয়েকটি লাইন;
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে,
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুতে লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি ৷
বিদ্রোহের কবি, মানবতার কবি, প্রেমের কবির জয় হোক।
No comments
Post a Comment