
বইয়ের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ি। আমাদের দেশে শিক্ষিত মহল হিসেবে পরিচিত যে সমাজ তাদের অন্দরমহলে বইয়ের সমাদর এখনো আশানুরূপ বাড়েনি। যার দরুন আমরা জাতি হিসেবে কৃতধী হতে পারিনি।
নিজের দেশের চৌহদ্দির বাইরে নজর ফেললে দেখা যায় বই আর বই। বইয়ের মাহাত্ম্য কীর্তনের কোনো সীমা বা সরহদ্ নেই। যুগে-যুগে মনীষীরা বইয়ের ব্যবহারের বিষয়ে যে-সব কথা বলেছেন সে-সবের সঙ্গে পাঠকদের কম-বেশি পরিচয় আছে। সভ্যতা যত এগিয়েছে বইয়ের কদরও তত বেড়েছে। সুলিখিত বই মানুষকে রুচিশীল হওয়ার প্রণোদন যোগান দেয়। আর সে-জন্যই হয়তো সভ্যতাধবংসকারীরা সবার আগে গ্রন্থাগার ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। যার ইতিকথা ইতিহাসের পাতাকে মসিলিপ্ত করে রেখেছে। সে-সব পর্ব পার হয়ে মানুষ তার মনে সুষমার শ্ৰেষ্ঠ আশ্ৰয় হিসেবে খুঁজে নিয়েছে বইয়ের জগৎ । তাই আধুনিক পৃথিবী বইয়ের জগৎ দিয়ে ঘেরা। আধুনিক বিশ্বের সারস্বতসমাজ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি জিজ্ঞাসু। হেন বিষয় নেই যা গ্রন্থভুক্ত হয়নি। রাশি রাশি বই তার রকমারি চেহারা আর পাঠকেরও পাঠস্পৃহা অদম্য— উন্নত দেশগুলির এটাই চারিত্র্য হয়ে উঠেছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় বইমেলারও সূচনা পাশ্চাত্যে। জার্মানির লিপজিগ বইমেলাই পৃথিবীর প্রাচীনতম, যার শুরু পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
অধ্যয়নতপস্যা কথাটির সঙ্গে আমাদের যে পরিচয় তা অনেকটা ছাত্রজীবনের অনুষঙ্গ বহন করে তাই বোধহয় আমাদের বেশির ভাগ লোক ছাত্রোত্তর জীবনে বইবিমুখ হ’য়ে পড়ে। তারা বইকে জীবনযাপনের জন্যে অপরিহার্য মনে করে না। আর্থনীতিক দুরবস্থার কথা তুলে বই না-কেনার পক্ষে কোনাে যুক্তি টেকে না। কারণ স্বল্প আয়ের মানুষেরা বই ছাড়া অন্যসব সামগ্ৰী কিনতে পিছপা হয় না। আসলে বইকে ভালোবাসার শিক্ষা আমরা পাইনি যে-শিক্ষা অন্যান্য দেশের পাঠক পেয়েছে অনেক দিনের সাধনায়।
প্রমথ চৌধুরী বই পড়া বিষয়টি তুলে ধরেছেন এই ভাবে : “জ্ঞানের ভান্ডার যে ধনের ভান্ডার নয়, এ সত্য প্রত্যক্ষ; কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও এও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভান্ডার শূন্য, সে জাতির ধনের ভাড়েও ভবানী। তার পর যে জাতি মনে বড় নয়, সে জাতি জ্ঞানেও বড় নয়; কেননা ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞানসাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টিও মনসাপেক্ষ। এবং মানুষের মনকে সবল সচল সরাগ ও সমৃদ্ধ করবার ভার আজকের দিনে সাহিত্যের উপর ন্যস্ত হয়েছে। কেননা মানুষের দর্শন-বিজ্ঞান ধর্ম-নীতি অনুরাগ-বিরাগ আশা-নৈরাশ্য তার অন্তরের স্বপ্ন ও সত্য, এই সকলের সমবায়ে সাহিত্যের জন্ম। অপরাপর শান্ত্রের ভিতর যা আছে, সেসব হচ্ছে মানুষের মনের ভগ্নাংশ; তার পুরো মনটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় শুধু সাগত্যে। দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি সব হচ্ছে মহাগঙ্গার তোলা জল, তার পূর্ণ স্রোত আবহমান কাল সাহিত্যের ভিতরেই সোল্লাসে সবেগে বয়ে চলেছে; এবং সেই গঙ্গাতে অবগাহন করেই আমরা আমাদের সকল পাপ হতে মুক্ত হব। অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের বই পড়তেই হবে, কেননা বই পড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চার উপায়ন্তর নেই।”
No comments
Post a Comment