নানান ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের অনেকেরই বই পড়ার সময় হয়ে ওঠে না। তাই ঝটপট করে চলতি পথে কোনো বইয়ের আংশিক কিছু অংশ পড়ে ফেলা যায় তাহলে মন্দ হয় না। আসুন আজ পড়ি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী আনন্দধারার কিছু অংশ।
ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। এর পরেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ঢোকার বছর। সেটা ছিল আমাদের অফ পিরিয়ড, অর্থাৎ যাকে বলে বিরতি—ঘণ্টা। সবাই হৈ চৈ করছে———কেউ কেউ গান করছে কোরাসে। আমিও গাইছিলাম। হঠাৎ রুদ্রমূর্তি নিয়ে ক্লাশে ঢুকলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই। সেদিন হেডমাস্টারমশাই আসেননি। সমস্ত ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গেল। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'কারা গান করছিল'? খানিকক্ষণ সব চুপ। আমি ধীরে ধীরে দাঁড়ালাম, বললাম, 'আমি স্যার'! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম আর কেউ দাঁড়াচ্ছে কিনা। না আর সব চুপ, শান্ত হয়ে বসে আছে। উনি বললেন, 'আমার সঙ্গে অফিসে এসো।'
গেলাম অফিসে। উনি রেজিস্টার খাতা বার করলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না উনি কী করতে চান। তারপর লাল কালি দিয়ে দুটো কি তিনটে রেজিস্টার খাতায় আমার নামগুলো কাটলেন। বললেন, 'যাও, এবার গান গেয়ে বেড়াও। স্কুল থেকে তোমায় তাড়িয়ে দেওয়া হল।'
আমি অফিস থেকে বাইরে এলাম। ক্লাসের বন্ধুরা সব বাইরে দাঁড়িয়ে। সবাই শুনে অবাক। সবাই রাগে গজগজ করছে। আমাদের ক্লাসের দেবকুমার রায় একটু বেপরোয়া ধরনের ছেলে ছিল, (এখন দেবকুমার খুব বড় পুলিস অফিসার) সে সোজা চলে গেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। দেবকুমার বলল, 'স্যার, অন্যায় আমরা সবাই করেছি, তাহলে আমাদের সবাইকে তাড়ান। শুধু ওকে শাস্তি দিচ্ছেন কেন?'
উনি বললেন, 'গেট আউট।'
তারপর বই—খাতা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। সঙ্গে রমা, সুভাষ, শ্যাম সব বন্ধুরা বাড়ি পর্যন্ত এলো। রাস্তায় কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। শুধু ভাবলাম, যে কথা সবাই বলে তা যে এতো সত্যি তা আগে বুঝতে পারি নি। বলে———মিত্র স্কুল বড়োলোকদের স্কুল, তাদের সব মাপ। আমরা তখন ভীষণ গরিব। হাফ ফি—তে পড়ি। বাবা সাধারণ কেরানি। সত্যিকথা বলায় এত বড়ো শাস্তি! একটা ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিলেন! এ কেমন বিচার? যত বাড়ির কাছে আসতে লাগলাম ততই ভয় এবং কান্না ঠেলে আসতে লাগল। বাড়িতে ঢুকে চুপ করে বসে রইলাম। মা বললেন, 'কিরে কী হয়েছে? মুখখানা অমন শুকনো কেন?' মা স্নেহময় হাত পিঠে রাখতেই আর চোখেরজল আটকানো গেল না।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্কুল থেকে নাম কাটা গেল কেন?'
সেদিন কোনো কথা লুকোইনি বাবার কাছে। সব বললাম। বাবা শুনে বললেন, 'মাস্টারমশাই ছিলেন না বলে ক্লাসে বসে গান গাইবে? অন্যায় করেছ। কিন্তু তাই বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই এতবড়ো শাস্তি দিলেন! ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র তিনমাস বাকি।'
আর দাঁড়াননি বাবা। আপিসের কাপড় আর ছাড়া হল না। বেরিয়ে গেলেন।
বাবা গিয়েছিলেন হেডমাস্টারমশাই—এর কাছে। ওঁকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, 'জানেনই তো আমার অবস্থা। সামান্য মাইনের কেরানি। একটা বছর নষ্ট হলে আমি মারা পড়ব। এ তো ছেলেকে শাস্তি দেওয়া নয় তার বাপের জরিমানা। এবারটা ওকে মাপ করে দিন।'
হেডমাস্টারমশাই সব শুনে সহানু)ভূতি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে কিছু করতে পারেননি। বলেছিলেন, 'শাস্তিটা তো আমি দিইনি। দিয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই। ওঁকেই বুঝিয়ে বলুন।'
অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই শেষপর্যন্ত শাস্তিটা নাকচ করেছিলেন। কিন্তু তার জন্যে বাবাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। একরকম হাতে পায়ে ধরতে হয়েছিল, তবে ছেড়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই। বড় রুক্ষ, বড় কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই। ছেলেদের যদি ছুতোয়নাতায় একটু নাকানিচোবানি না খাওয়ালেন, তো কিসের মাস্টারিগিরি।
বাবা বাড়ি ফিরে যখন মাকে কথাটা জানালেন তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মা। ঠিক সেই সময় আমার কান্না পাচ্ছিল। তবু কাঁদিনি———কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ভেতর ভেতর চোখের জলটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার সারা মনটাকে। মনে হচ্ছিল কেন বাবা আমাকে মারলেন না। নিদেনপক্ষে একটা কড়া ধমক। আমারই জন্যে তো বাবাকে এত ছোটাছুটি করতে হল আপিস থেকে বাড়ি ফিরেই! আমারই জন্যেই তো বাবাকে এত অপমান সইতে হল। অথচ বাবা আমাকে কিচ্ছু বললেন না।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments
Post a Comment