বানানরাজ্যে যিনি বিপ্লব এনেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথ এবং বানান-সংস্কারে রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘কৰ্ণধার’ মনে করেন সেই সুনীতিকুমারের মধ্যে মতভেদ আকাশ-পাতাল। রবীন্দ্ৰনাথের ঝোক হ্রস্ব-ইকারের দিকে, সুনীতিকুমারের আসক্তি দীর্ঘ-ঈকারের প্রতি। ‘ঘটী’ শব্দ সংস্কৃত কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথ লেখেন “ঘটি”। “নিম্নস্থানস্থিত” অর্থে “নীচ’ শব্দ সংস্কৃত চৈতন্য-শ্লোকাষ্টক, মেঘদূতম, শ্ৰীমদভগবদগীতা, মনুসংহিতা, এমন কি ঋগ বেদেও আছে। এইসকল গ্রন্থের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল এবং “নীচ” বানান নিশ্চয়ই তিনি বহুবার দেখেছেন। কিন্তু কবির হঠাৎ মনে হল ‘নীচ’ শব্দ "below” অর্থে সংস্কৃত ভাষায় নেই, অতএব তিনি বেশী চিন্তাভাবনা না করেই বিধান দিয়ে বসলেন। “নিচে শব্দটিকে সম্পূর্ণ প্ৰাকৃত বাংলা বলিয়াই স্বীকার করিয়া থাকি।” (শব্দতত্ত্ব)। দেবপ্ৰসাদবাবুর নিকট একখানি চিঠিতে রবীন্দ্ৰনাথ “দায়ী” শব্দের বানান লিখেছিলেন “দায়ি”। দেবপ্রসাদবাবু আক্রমণ করলে কবি উত্তর দিলেন “জরাজনিত মনোযোগের দুর্বলতা”। আমরা কিন্তু তা মনে করি না। আমাদের বিশ্বাস “প্রবণতাজনিত মনোযোগের দুর্বলতা” আসলে দায়ী” যে তৎসম শব্দ রবীন্দ্ৰনাথ অতটা মনোযোগ করে দেখেন নি, এবং হ্রস্ব-ইকারপ্রবণতার জন্যই লিখেছিলেন ‘দায়ি’। তবে দেবপ্রসাদবাবুর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের অতটা বিচলিত হওয়ার তেমন হেতু ছিল না, কারণ “দায়ক” অর্থে ‘দায়ী” শব্দ তৎসম হলেও, 'responsible' অর্থে শব্দটি সংস্কৃত নয়, বাংলা। রবীন্দ্ৰনাথের বিধানে শেষোক্ত অর্থে ‘দায়ি’ বানান ভুল নয়।

পক্ষান্তরে, সুনীতিকুমার তৎসম শব্দ তো দূরের কথা, মূলে দীর্ঘঈকার থাকলে তদ্ভব শব্দতেও কদাপি হ্রস্ব-ইকার দেবেন না। ‘একটি, কলমটি, গাছটি’ সুনীতিকুমারের হাতে ‘একটী, কলমটী, গাছটী’, কারণ ‘টী’ সংস্কৃত ‘বধুটী’ শব্দ থেকে আগত। ‘খুটিনাটি’ সুনীতিকুমারের লেখনীতে ‘খুটােনাটী’। ১৯৫০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্ৰকাশিত, সুনীতিকুমারের ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘খুটীনাটী’ মুদ্রিত আছে। ১১২ পৃষ্ঠায় দেওয়া কয়েকটি বৈদেশিক শব্দের বানান দেখলেই সুনীতিকুমারের প্রবণতা কোন দিকে বোঝা যাবে -
প্ৰবন্ধ-লেখকের কাছে একখানি চিঠিতে সুনীতিকুমার ইংরেজী report শব্দের বাংলা বানান লিখেছিলেন “রীপোর্ট”। প্রশ্ন করলে উত্তর দিলেন “খেয়াল ছিল না।” অর্থাৎ খেয়াল না থাকলে রবীন্দ্রনাথের কলমে আসে হ্রস্ব-ইকার, সুনীতিকুমারের আসে দীর্ঘঈকার। কথাপ্রসঙ্গে সুনীতিকুমার একদিন বলেওছিলেন “দীর্ঘ-ঈকার ‘ী’ লেখা সোজা”। বাস্তবিকই বাংলা বর্ণবিন্যাসে স্বরচিহ্নের মধ্যে হ্রস্ব-ইকার ‘ি’ লেখাই সর্বাপেক্ষা কষ্টদায়ক। সাধারণ কথাবার্তার যুক্তি হয়তো গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না, তবে সুনীতিকুমারের দীর্ঘ-ঈ কার-প্রবণতার এটাও একটা কারণ যে হতে পারে না তা নয়।
হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ প্রসঙ্গে বানান-সংস্কার-সমিতিও দ্বিধাগ্ৰস্ত। রেফের পর দ্বিত্ব-বর্জনের ক্ষেত্রে সমিতি দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, কিন্তু হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ ব্যাপারে সমিতি যেন অসহায়।
ফলে কবির ভাষাই মনে আসে :
সূত্রঃ বাংলা বানান - মণীন্দ্রকুমার ঘোষ।
পক্ষান্তরে, সুনীতিকুমার তৎসম শব্দ তো দূরের কথা, মূলে দীর্ঘঈকার থাকলে তদ্ভব শব্দতেও কদাপি হ্রস্ব-ইকার দেবেন না। ‘একটি, কলমটি, গাছটি’ সুনীতিকুমারের হাতে ‘একটী, কলমটী, গাছটী’, কারণ ‘টী’ সংস্কৃত ‘বধুটী’ শব্দ থেকে আগত। ‘খুটিনাটি’ সুনীতিকুমারের লেখনীতে ‘খুটােনাটী’। ১৯৫০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্ৰকাশিত, সুনীতিকুমারের ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘খুটীনাটী’ মুদ্রিত আছে। ১১২ পৃষ্ঠায় দেওয়া কয়েকটি বৈদেশিক শব্দের বানান দেখলেই সুনীতিকুমারের প্রবণতা কোন দিকে বোঝা যাবে -
ফরাসী, আরবী, তুর্কী, আমীর, উজীর, নকীব, মীর্জা, বক্সী, আদমশুমারী, ওয়াশীল, বীমা, উকীল, দলীল, ফরিয়াদী, ঈদ, গাজী, নবী, শহীদ, সুন্নী, হাদীস, হুরী, আতশবাজী, কাঁচী, দূরবীন, বরফী, মিছরী, মীনা, মুহুরী, সানকী।
প্ৰবন্ধ-লেখকের কাছে একখানি চিঠিতে সুনীতিকুমার ইংরেজী report শব্দের বাংলা বানান লিখেছিলেন “রীপোর্ট”। প্রশ্ন করলে উত্তর দিলেন “খেয়াল ছিল না।” অর্থাৎ খেয়াল না থাকলে রবীন্দ্রনাথের কলমে আসে হ্রস্ব-ইকার, সুনীতিকুমারের আসে দীর্ঘঈকার। কথাপ্রসঙ্গে সুনীতিকুমার একদিন বলেওছিলেন “দীর্ঘ-ঈকার ‘ী’ লেখা সোজা”। বাস্তবিকই বাংলা বর্ণবিন্যাসে স্বরচিহ্নের মধ্যে হ্রস্ব-ইকার ‘ি’ লেখাই সর্বাপেক্ষা কষ্টদায়ক। সাধারণ কথাবার্তার যুক্তি হয়তো গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না, তবে সুনীতিকুমারের দীর্ঘ-ঈ কার-প্রবণতার এটাও একটা কারণ যে হতে পারে না তা নয়।
হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ প্রসঙ্গে বানান-সংস্কার-সমিতিও দ্বিধাগ্ৰস্ত। রেফের পর দ্বিত্ব-বর্জনের ক্ষেত্রে সমিতি দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, কিন্তু হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ ব্যাপারে সমিতি যেন অসহায়।
ফলে কবির ভাষাই মনে আসে :
“দেশ অরাজক ?”
“অরাজক কে বলিবে, সহস্ররাজাক।”
সূত্রঃ বাংলা বানান - মণীন্দ্রকুমার ঘোষ।
লেখাটা পড়ে বেশ ভাল লাগল।
ReplyDeleteভালো লাগল।
ReplyDelete