Oriental Tales by Marguerite Yourcenar এই বইটিতে দেবী কালীকে নিয়ে "কালীর শিরচ্ছেদ" (Kali Beheaded) শিরোনামের একটি গল্প আছে। গল্পটি ফ্রেঞ্চ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আমার আরেক প্রিয় লেখক Alberto Manguel, যার হিস্টোরি অব রিডিং আমার খুবই প্রিয় একটি বই।
কালীকে নবরূপায়ণে উপস্থাপিত করেছেন এই বিদেশী নারী গল্পকার। তিনি লেখেন, চরাচরের এমনই একটা ঘোর অন্ধকারে, পৃথিবীর এক বড় দুঃসময়ে শিবসহ সব দেবতা মিলে স্থির করেন কালীর আবির্ভাব মর্তে একান্তই জরুরি এই মুহুর্তে। সঙ্গে সঙ্গে দেবকুলের নির্ধারিত শর্তে মর্তে এসে হাজির হন কালী। কিন্তু কালীর ক্ষমতা, শক্তি ও বীরত্ব দেখে দেবতারা শঙ্কিত এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তারা কালীর গলা কেটে দেহ থেকে ব্যবচ্ছেদ করে দেন। পরে নিজেদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তারা ফের কালীর ধড় ও মস্তক একত্রে জোড়া লাগাতে মর্তে আবির্ভূত হন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় ঘটে যায় এক মহাবিপৰ্যয়। কালীর খণ্ডিত মাথাটি যেখানে গিয়ে পড়েছিল সেখান থেকে মহানগরের সবচেয়ে বড় গণিকালয় খুব দূরে নয়। সেদিনই সন্ধ্যায় সেই গণিকালয়েও একটি গণিকাকন্যা খুন হয়। ওই পল্লীতে এরকম মাঝে মধ্যে দু-একটা নারীর খুন হওয়ার ঘটনা খুব অসাধারণ বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কোনো খরিদ্দার, নাকি কোনো ঈর্ষাকাতর গোপন প্রেমিক অথবা গণিকালয়ের স্বার্থাম্বেষী কোনো দালালের সঙ্গে অর্থ নিয়ে অবনিবনা হওয়াই মেয়েটির ধড় থেকে গলা কেটে মস্তকটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য দায়ী, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মৃতদেহের দুটাে টুকরোই অর্থাৎ মস্তক ও ধড়, দুটােই টেনে এনে গণিকালয়ের লোক ফেলে দিয়েছিল নিকটবতী সেই মাঠে, যেখানে অনেক দূর থেকে বাতাসে উড়ে এসে পড়েছিল সেই অকুতোভয়, অসুরবিনাশিনী কালীর ধড় আর কাটা মুণ্ডুটিও। স্বৰ্গ থেকে দেবতার চর এসে যখন দেখে সেখানে মাঠের ওপর পড়ে আছে পাশাপাশি দুটি মস্তক ও দুটি ধড়, সে তাড়াতাড়ি করে সঠিক মুণ্ডুটি বেছে নিয়ে ওটাকে জোড়া দিয়ে দেয় ভুলক্রমে পাশেই পড়ে থাকা গণিকার ধড়ের সঙ্গে। অতঃপর তাতে প্ৰাণ সঞ্চার করে স্বর্গের দেবতারা। সব কাজ শেষ হলে শিব দূর থেকে মন্ত্র পড়ে তাকে কালীতে রূপান্তরিত করে। কিন্তু কেউ তখনো জানে না যে, মুণ্ডুটা কালীর হলেও শরীরটা একজন গণিকা কন্যার। ফলে রুদ্রময়ী কালী তার তরবারি দিয়ে দুর্জনকে একনাগাড়ে বধ করে গেছেন সত্য, গলায় পরেছেন ব্যবচ্ছেদ করা দুর্জনের খণ্ডিত মুণ্ডুর মালা। নিহত বা আহত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে একটি করে মহাসুরের নতুন করে জন্ম রোধ করার উদ্দেশে কালী ক্রমাগত রক্ত চুষে নিতে থাকেন তার তাবৎ শিকার থেকে। কিন্তু এই যে বিশাল শক্তিধর, প্ৰচণ্ড সাহসী, বীর কালী যে বিশ্বসংসারে সংশয় ও শঙ্কাবিহীন বলে পরিচিত, সে কিন্তু রাত হলেই অন্য এক নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তার দেহ, যা আসলে এক গণিকার দেহ, তাকে প্ররোচিত করতে থাকে গণিকালয়ের খুপরিতে ঢুকে যেতে এবং জানালার পাশে বসে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, নেচে-কুঁদে-গেয়ে খদ্দেরের মন ভোলাতে। তারপর রাতভর শরীর-শরীর খেলায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতে থাকে সে। দিনের কালীর ন্যায়পরায়ণতা ও প্রচণ্ড দাপটে দুর্জন বধের আকাজক্ষা আর রাতের কালীর শরীর থেকে উৎসারিত অসীম ভােগের আকাজক্ষা মিলে যে দেবতার সৃষ্টি হয় সেই কালীই হয় মানুষের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন এবং চেনা দেবতা। কেননা সে শুধুই কল্যাণময়ী, শুধুই দুৰ্জনবন্ধকারী, শুধুই সব ভালো এবং দেবতুল্য গুণের সমন্বয় নয়; সে কেবলই শক্তির প্রতীক নয়, তার মস্তিষ্ক যা-ই বলুক, তার শরীর লালায়িত হয়ে ওঠে পুরুষ সঙ্গলাভের জন্য। উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীর আকর্ষণীয় শরীর নিয়ে তখন সে প্রকাশ করে তার ভোগের জন্য কাতরতা। বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ছলাকলা তাকে মানবিক করে তোলে। ভালো ও মন্দের একত্র সহবাস, একই শরীরে ভক্তি ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা কালী দেবীকে আমাদের কাছের মানুষ বানিয়ে ফেলে। একজনের দেহ ও অন্যজনের মুণ্ডু দিয়ে গড়া এই সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের কবন্ধ কালীকে আবিষ্কার করেছিলেন উপকথা নিয়ে গল্পরচনাকারী বিখ্যাত নারী-লেখক মারগারিত ইউরসেনার, বেলজিয়ামে যার জন্ম এবং ফ্রান্স ও আমেরিকার যৌথ নাগরিক ছিলেন যিনি।
তথ্য-সূত্রঃ পুরবী বসু।