সরদারের বড় ভাই মঞ্জে আলী সরদার ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, রমজান মাসের ৩০টি রোজা পালন করতেন বিনা ব্যতিক্রমে। বালক সরদার নিজেও গ্রামের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন, তেলাওয়াত করতেন সুলললিত কষ্ঠে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু থেকে তার আবেগাপুত আবৃত্তি। বাড়ির লোকেরা, বিশেষত বোনেরা প্রায়ই বালক সরদারকে ডেকে বলতেন, ‘করিম, বিষাদসিন্ধুর ওই জায়গাটা পড় তো ভাই! বড় সুন্দর পড়িস তুই! চারধারে মাটির ঘরবেষ্টিত ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন উঠানে বিষাদসিন্ধু খুলে বসতেন বালক সরদার। কারণ আবেগমিশ্ৰিত সুরে পাঠ উপাখ্যান ।
এহেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে সরদার ফজলুল করিম কী করে সাম্যবাদের আদর্শে দীক্ষা পেয়েছিলেন সে কথা বলতে গিয়ে সরদার প্রায়ই বলেন জনৈক মোজাম্মেলের কথা। বরিশাল জেলা স্কুলে সরদার যখন নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন একদিন সেই সহপাঠী বন্ধু মোজাম্মেল (রেভুলেশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা আরএসপিআই’র কর্মী ছিলেন কিশোর মোজাম্মেল । পরবর্তীকালে সুপরিচিত সাংবাদিক মোজাম্মেল হক, ১৯৬২ সালে কায়রোতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) তাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন। বইটি পড়তে দেওয়ার সময় মোজাম্মেল নাকি সরদারকে বলেছিলেন, ‘করিম, তুমি বড়ো গুড বয়। কিন্তু এত গুড বয় হওয়া কোনো কাজের কথা না। খালি ক্লাসের বই মুখস্থ করলে হইব না। এই বইখানা পড়ো! এক রাতের মধ্যে পড়ে শেষ করতে হবে । খবরদার। কেউ যেন না জানে!" সে বইয়ের ছিল না মলাট । কোথাও না ছিল বইয়ের না লেখকের । ফোলিওর যে জায়গায় বইয়ের নাম লেখা থাকে, প্রত্যেকটি পাতার সে জায়গায় ঘনকালো কালিতে মুছে দেওয়া হয়েছে বইয়ের নাম। সরদার সারা রাত জেগে পড়েন সে বই পড়তে পড়তে এক অভূতপূর্ব রোমান্টিক জগতে পদার্পণ ঘটে কিশোর সরদারের। অবশ্য পড়ার নেশা তাকে ইতোমধ্যেই পেয়ে বসেছিল। বরিশাল জেলা স্কুলে পড়ার সময় তিনি যে হোস্টেলে থাকতেন, সেখানে রাত দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু ঘুম আসত না কিশোর সরদারের চোখে, তিনি বই নিয়ে হোস্টেলের দেয়াল টপকে চলে যেতেন জাহাজঘাটে। সেখানে স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় বসে বসে পড়তেন রাজ্যের যত বই।
২০০৬ সালের দিকে একবার সুযোগ হয়েছিল স্যারের সাথে বসে ৫ দিন ব্যাপী এক দীর্ঘ আড্ডার। সেই আড্ডা রেকর্ড করা সম্পূর্ণ অংশ আজও আমার কাছে আছে, মাঝে মাঝে দেখি পর্দায় স্যার ভেসে ওঠেন কি সাবলীলভাবে অনর্গল কথা বলে যান। তিনি বলেন, ‘মানুষ হচ্ছে একটি বই, বই তোমাদের কাছে যাবে না, তোমাকে বইয়ের কাছে যেতে হবে’। ‘এখানে সাধারণরা অসাধারণ, অসাধারণরাই সাধারণ। তোমাদের নিচ থেকে উপর দিকে তাকাতে হবে। উপর থেকে নিচে নামা সহজ। কিন্তু নিচ থেকে উপরে ওঠা কঠিন। এ বোধ তোমাদের আনতে হবে’। ‘মৃত্যুকে তোমরা ভয় করিও না। বাংলাদেশে মৃত্যু certain এবং বেঁচে থাকা Uncertain. মানুষকে মেরে শেষ করা যায় না। কচুরিপানা থেকেও মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী’। ‘তোমাকে কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে তুমি ধর্মান্ধ বিরোধী। আর মোকাবিলা করতে হবে কর্মের মাধ্যমে’। ‘পুঁজিবাদের সঙ্কটকেই তিনি মুক্তবুদ্ধি চর্চার বাধা হিসেবে দেখান। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতীকী সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদেরকে মহাসমুদ্রে (মহাসঙ্কটে) ফেলা হচ্ছে, সেখানে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি অথচ সাতার শিখবার মতো শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেছিলেন, ‘সবসময় মনে রাখতে হবে, মানুষকে মেরে শেষ করা যায় না। যে মারে সেই মরে। আর যে মরে সে মরে না’ । কথাগুলো কেন যেন আজ বেশি বেশি মনে পড়ছে। আমাদের মূল সমস্যা শিক্ষা ব্যবস্থায়, যার পরিবর্তন না আনলে আমাদেরকে হয়ত আরো মার খেতে হবে।
No comments
Post a Comment