
'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।' মাঝে হতাশা গ্রাস করে, মনে হয় 'এ যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে।' তারপরেও নতুন পথের সন্ধান করতে হয়। এই সন্ধান অনেকটা আমাদের নিজেদের উপরই নির্ভর করে। কবি আল মাহমুদের অনেক কিছুই যেমন আমি মেনে নিতে পারি না। ঠিক তেমন ভাবেই তিনি যে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি এটাও অস্বীকার করার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে পারি না। কেমন করে অস্বীকার করি,
"আম্মা বলেন, পড় রে সোনা
আববা বলেন, মন দে ;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
...
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।"
আমাদের স্কুল-কলেজে সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে সাহিত্যিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। তাই বড় হয়ে (অমানুষ হয়ে পড়ুন) আমরা সাহিত্যিক মূল্যবোধ কি জিনিস বুঝি না। আমাদের চোখে দেখি অন্যের দেখানো মূল্যবোধ। কিভাবে চিন্তা করবো না শিখিয়ে কি চিন্তা করবো শেখানো হয়। অনেক কিছুই আমি মেনে নিতে পারি না।আমার প্রাতিষ্ঠানিক সব ধর্মে মোহহীন অনাস্থা। কিন্তু এগুলো আমাকে ধার্মিকদের প্রতি অনুদার করেনি। জীবনযাপনের নানান-রকম শর্তের মধ্যে যেমন আছে মানিয়ে চলা, অন্যমতের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন তেমনি সামাজিক অবস্থানেও সেই অভ্যাস রক্ষায় আমি সচেষ্ট। তাঁর শেষ বয়সের কবিতায় কবিতার শিল্প-সফলতা খুঁজে পাইনি বলে হ্যাঁ স্বীকার করি যে আল মাহমুদ এক সময় পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। নানারূপ স্খলন-পতনের শিকার হয়েও তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন তাঁর কবিতার প্রসাদগুণের কারণে।
এখনো আল মাহমুদের অনেক কবিতা মুখস্থ,
"ব্রহ্মদেশের বাতাস এসে দরজা টানে রোজ
কোথায় পেল আমার মতো দুষ্টু ছেলের খোঁজ !"
...
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
—হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
...
আমাদের দিন শেষ হয়ে গেছে সই,
তোমার ছাপানো শাড়িতে নদীর নাম—
দেখে আর কেউ করবে না হই-চই ;
বিস্মৃতির শেষ প্রেমিকের পরিণাম।
আমার কিশোরবেলা তো ডানা মেলেছে তাঁর কবিতায়, তাই বা ভুলি কিভাবে; 'কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি / সে তো ভেসে ওঠা ম্লান'।
"সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলির কূলটায়।
দুধভরা ওই চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।"
...
কালচক্রের কামনার কাছে দায়ী
জেনো গরীয়সী আমরা তো কেউ নই,
শেষ শয্যায় রয়েছি শয্যাশায়ী
আমাদের দিন শেষ হয়ে গেছে, সই।
আহারে কবি...।
No comments
Post a Comment