অনেকেই হয়তো জানেন আমি ফেসবুকে একটি বইয়ের গ্রুপ পরিচালনা করি, তাও অনেক বছর হলো। ইদানীং অদ্ভুত সব অনুরোধ আসে এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু কথা বলতে চাইছি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক হতে হলে শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। আমাদের চারপাশে এত এত শিক্ষিত মানুষ অথচ আমাদের গণতন্ত্রের এমন দশা কেন? উচ্চশিক্ষার এবং মনুষ্যত্বের ঋজুতা বিবেকানন্দের ভাষায় প্রাথমিক স্তর থেকেই 'অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত' করা উচিত। একটি বহুতল ভবন যেমন ভালো গাঁথুনি ছাড়া সম্ভব নয় তেমনই প্রাথমিক স্তর মানুষের জীবনের ভিত্তিস্বরূপ। অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অন্ধের হস্তী-দর্শনের মত। পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দিতে বা নিতে কোনটাতে আমাদের আর আগ্রহ নেই।
আমরা সবকিছুর সারাংশ খুঁজি। এক ট্যাবলেটে সকল অসুখ নিরাময় পদ্ধতি যেমন কার্যকর নয় তেমনই সারাংশ শিক্ষাও কোন কাজের নয়। প্রাথমিক শিক্ষায় কি জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সামাজিক ও বংশমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা কি আমরা পাই? অচ্ছুৎ, গরীব বলে এক শিশুর পাশে আরেক শিশুকে বসতে না দেওয়ার শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্র বসু বলতেন বিদ্যালয়ের উচিত চরিত্রবান মানুষ তৈরি করা, যারা জাতির জন্য জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহত্ত্ব অর্জন করে মহৎ হবেন। কিন্তু সেটা কি হয়েছে? শিক্ষা ও উন্নতির প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জীবনে উন্নতির যেমন শর্টকাট নেই তেমনি শিক্ষারও শর্টকাট হয় না। কিন্তু আমাদের মূল্যবোধ ধসে গেছে এমন জায়গায় যে শিক্ষক নোট দেন না তাঁর কাছে অভিভাবকেরা সন্তানদের পাঠান না।
স্কুলেজীবনে একদিন বাবা বলল অমুক স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়তে যাবি। প্রথম দিন যাওয়ার পরে বাসায় এসে বললাম ঐ স্যার ভালো না, কোন নোট দেন না। সমস্ত বই পড়ান। ঐ দিন রাতে বাবা কিছু বলে নি। কিন্তু সকালে কাছে ডেকে বললো, 'তোকে উনার কাছে পাঠিয়েছি আসলে কেমিস্ট্রি শেখার জন্য নয়। তুই শিখবি উনি কিভাবে পড়ান। সেটা আয়ত্ত করতে পারলে তোকে সারাজীবনে কোনদিন ব্যাচ পড়তে হবে না'।
পরে যখন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বাঙালীর ভবিষ্যৎ বইটি পড়ি তখন দেখি উনি এমন কথাই বলে গেছেন, "আমরা বাল্যকাল হইতেই উপরচালাকি বা ফাঁকিদারি দ্বারা কাজ ফতে করিতে চাই। রীতিমত পরিশ্রম করিয়া বিদ্যার্জন করা যেন এখন রেওয়াজের বাইরে।........কোন শিক্ষক বা অধ্যাপক যদি একটু বেশি রকমের ব্যাখ্যা করেন, তাহা হইলে ছেলেরা অধৈর্য হইয়া উঠে এবং সে অধ্যাপক অপ্রিয় বা ছাত্রদের বিরাগভাজন হইয়া উঠেন।......যে-শিক্ষক যত নোট দিতে পারেন তিনি ছাত্রসমাজে তত প্রশংসার ভাজন হন। এইরূপে গোড়াতেই কাঁচা থাকার দরুন প্রকৃত শিক্ষা হয় না।" এই প্রকৃত শিক্ষার অভাবে আমরা এমন বই খুঁজি যেখানে সকল কিছু থাকবে। গাইড বই পড়ে শিক্ষিত হওয়া শ্রেণী জীবনে এক সময় সাহিত্য সাধনায়ও গাইড বইয়ের খোঁজ করেন। এমন 'এক বই' যেখানে সব তথ্য-তত্ত্ব থাকবে। কিন্তু সাহিত্যে তো এমন বই হয় না। সাহিত্য তো কোন ধর্মগ্রন্থ নয় যা একটি মাত্র বইয়ে সকল কিছু ঠেসে দেওয়া যাবে। আমি তাদের প্রমথ চৌধুরীর সেই কথাটি স্মরণ রাখতে বলি, "শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।"
যদি রবীন্দ্রনাথকে পড়তে ও বুঝতে চান তাহলে সমগ্র রবীন্দ্রনাথ পড়ুন। জোড়াতালি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়বেন না। বর্তমানের প্রযুক্তি আমাদের অনেককিছু দিয়েছে যেমন তেমন আবার আমাদের অভ্যাসও খারাপ করে দিয়েছে, যা আমাদের সব কিছুকে ছোটো করে কেটে-ছেঁটে হাতের মুঠোয় ধরাবার মতো তৈরি করে নিতে শেখায়৷ এটা ইতিহাস, ওটা সাহিত্য, এটা অর্থনীতি, ওটা সংগীত, এটা সমাজতত্ত্ব, ওটা শিল্প, এটা বিজ্ঞান, ওটা আর একটা অন্য কিছু৷ এরকম আলাদা আলাদা নামে, ভাগে আমরা যত টুকরো বানাই, সমগ্র অবয়ব তত হারিয়ে যায়, গোটা আদল তত আবছা হয়ে আসে৷ এভাবে সমগ্র শিক্ষার থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি।
"‘হিন্দুমুসলমান সমস্যায় রবীন্দ্রনাথ’, ‘গ্রাম সংগঠনে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা’, ‘লোক-নৃত্যে ও লোকসংগীতে রবীন্দ্রনাথ’, ‘নবজাগরণে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও সংস্কৃত সাহিত্য’, ‘মানবধর্মের রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা’, ‘রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনা’, কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তা ও ছন্দচিন্তা’ ইত্যাদি যাবতীয় ভাগে রবীন্দ্রনাথকে ভাগ করেছি আমরা। কেউ নিশ্চয়ই বলবেন না যে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গিয়ে এর কোনো একটা প্রসঙ্গও বর্জনযোগ্য।’" নিশ্চয়ই তা নয়, কিন্তু এই প্রসঙ্গসূচি-পদ্ধতির মুশকিল এই যে সেই এতে করে সম্পূর্ণ শিক্ষা তৈরি হয় না।
যখন আপনি কম্পিউটার সায়েন্স পড়বেন তখন কেন আপনাকে শিল্পকলা পড়তে হবে, ইতিহাস, দর্শনের কি প্রয়োজন এক্ষেত্রে? প্রয়োজন আছে, সেটি তখন বুঝবেন যখন আপনি মানুষের সেবার জন্য ভালোর জন্য কোন সফটওয়্যার বানাবেন। তখন দেখবেন আপনার শেখা দর্শন, ইতিহাস, কলা সকল কিছু কাজে লাগছে। আমি বলছি না যে রাতারাতি সবকিছুর আদল পাল্টে ফেলতে হবে, তবে নিজের ঘর থেকে শুরু করতে দোষ কি! মনের গভীরে আমরা তো চাই আমাদের সন্তানেরা স্বশিক্ষিত হোক।
Notes
Share /
শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।
by rit.oneFriday, August 23, 2019
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments
Post a Comment