
"কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত
রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই
চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।"
- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
আমেরিকায় কালো মানুষের অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন তাকে অনেকেই অগ্রাধিকারের (privilege) সাথে তুলনা করছেন। আজ আমি অগ্রাধিকার (privilege) ও সাংবিধানিক অধিকার (constitutional right) নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবো।
আমি কিছু লেখালেখি করি, এটাকে সন্মান করে কোন প্রকাশক যদি আগ্রহ নিয়ে বই ছাপতে চান তাহলে সেটাকে আমি বলবো অগ্রাধিকার। কারণ এটা না করলেও প্রকাশক পারতেন। এটাকে আমি সুযোগ হিসেবে উপভোগ করবো, অধিকার হিসেবে নয়।
রাস্তায় আমাকে কেউ গলাটিপে মেরে ফেলবে না, ছোটখাটো অপরাধে গুলি করে আমার বুক ঝাঝরা করে দেবে না, কেউ নিজের ঘর মনে করে আমারই ঘরে ঢুকে আমাকে শটগান দিয়ে মেরে ফেলবে না, আমাদের কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে যা আমরা রাষ্ট্রের সাথে গচ্ছিত রেখেছি সেগুলো কেউ ছিন্ন করবে না, এমন সব অধিকারকে আমি বলবো সাংবিধানিক অধিকার বা তার চেয়ে বেশি কিছু 'মানবাধিকার'।
জর্জ ফ্লয়েডের ভিডিওতে আমরা দেখি যে একজন পুলিশ একজন মানুষের ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে চেপে ধরেছে এবং সে শ্বাস নেওয়ার জন্য আর্তচিৎকার করছে ।আমাদের এই আমেরিকায় চতুরতার সঙ্গে মেক্সিক্যানদের ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করানো হয় যেন তাদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়। এমন হাজারো ঘটনা ঘটছে, অতিতেও ঘটেছে। এই সব বৈষম্য সহজভাবে বুঝতে হলে নেটফ্লিক্সে প্রচুর সিনেমা রয়েছে, ডকুমেন্টারি রয়েছে সেগুলো দেখলেই ধারনা পাবেন। রাষ্ট্রের সাথে মানুষের একটি সাংবিধানিক সম্পর্ক থাকে, আমেরিকা রাষ্ট্র সেই সম্পর্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আমি আবারও বলছি, বিচারবহির্ভূতভাবে খুন না হওয়া কোনও অগ্রাধিকার (privilege) নয়, এটি ট্র্যাজেডির চেয়েও বেশি কিছু। এগুলোকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করে আধুনিক আমেরিকা সংখ্যালঘু বা দরিদ্র বা নিষ্পেষিত কালো মানুষদের প্রতি যে অবিচার করে চলেছে তা শুধু দুঃখেরই নয় এটা রাষ্ট্রীয় অপরাধ।
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন দাসপ্রথা নিয়ে বলেছিলেন যে, দাসপ্রথা যদি ভুল (অপরাধ) না হয়, তাহলে কোন কিছুই অপরাধ নয়। আমি বলবো মানুষের ঘাড়ে হাটু দিয়ে চেপে মেরে ফেলা যদি অপরাধ না হয়, তাহলে কোন কিছুই অপরাধ নয়। ছোট ছোট অভিবাসী বাচ্চাদের খাচায় বন্ধ করে রাখা যদি অপরাধ না হয় তাহলে কোন কিছুই অপরাধ নয়। এগুলো কেবলমাত্র উদাহরণ। আরও বড় বড় সমস্যা রয়েছে যার সমাধান এখনই করা না গেলে এদেশ এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

আপনারা ভাবছেন আমি সবসময় বই নিয়ে লিখি আজ এমন বিষয় টানছি কেন? বিশ্বাস করুন টানতে বাধ্য হচ্ছি। কোন এক বইয়ে পড়েছিলাম যে আপনি কিছু না করেও অন্যায় করতে পারবেন, যদি সেই সিস্টেমের গলদের প্রতিবাদ না করেন। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন "যে কোনও জায়গায় অন্যায় হওয়া মানে সর্বত্রই ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি," তাই সমস্ত পৃথিবী এখন আমারিকান কালোদের এই আন্দোলনের সাথে একাত্মবোধ করেছে। কিং আরও বলেছিলেন, “আমরা পস্পরের সাথে এমন এক সম্পর্কে জড়িত যে আজ যা আমাকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে তা অন্যকেও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে”। আমি জানি আমার কাছ থেকে এমন সব কথা আপনারা আশা করেন না। কিন্তু ভাবুনতো কি হবে এত এত বই পড়ে যদি সেগুলো কোন কাজেই না আসে।
আমরা সকলে নিজের নিজের একটা বৃত্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। এই বৃত্তের বাইরে কিছু হলে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা টাকা রোজগার করি, খাই দাই, রাতে টিভিতে সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। এই হলো আমাদের জীবন।
আপনাকে বুঝতে হবে যে রাষ্ট্র যদি কাউকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ পায় তবে একদিন তারা আপনার অধিকার থেকেও আপনাকে বঞ্চিত করবে। প্রকৃতপক্ষে এটাই ক্ষমতার অপব্যবহার, এটি ট্রাম্প বা পুটিন যার হাতেই থাকুক না কেন, এর প্রয়োগকারী আমলারা এই সব দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসকদের দ্বারা নিযুক্ত হয় এবং আদেশ অনুসরণ করেন। আপনি যদি ক্ষমতাকে একটুখানি ছাড় দেন তাহলে সে আরও একটু চাইবে। আপনার নিজের সাথে অন্যায় হচ্ছে না জেনে যখন আপনি অন্যায়কে ছাড় দেবেন তখন একদিন দেখবেন সেই অন্যায় আপনার গলাতেও হাটু তুলে দেবে। নিজের জন্য না হলেও অন্তত আপনাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে সোচ্চার হোন।
মার্টিন নিমোলারের গল্পটি বলি। নিমোলার ছিলেন জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ, তিনি শুরুর দিকে হিটলারের সাপোর্টার ছিলেন। হিটলারের অনেক কাজ নীতিগতভাবে সমর্থন করেননি কিন্তু সহ্য করেছিলেন। এমনকি কিছু কিছু মেনেও নিয়েছিলেন। যেমন ট্রাম্পের জন্য অনেকেই সেটি করছেন। ক্ষমতার সাথে আপোষ করে এমন মানুষ আমরা অহরহ দেখছি। শেষ পর্যন্ত নিমোলারের ভাগ্যে কি ঘটেছিল সেটি তার এক বিখ্যাত কবিতার মধ্যেই উল্লেখ আছে।
প্রথমে তারা কমিউনিষ্টদের ধরতে এসেছিল, এবং আমি কিছু বলি নি -
কারণ আমি কমিউনিষ্ট ছিলাম না।
তারপরে তারা শ্রমিক-আন্দোলনের কর্মীদের ধরতে এসেছিল, এবং আমি কিছু বলি নি -
কারণ আমি কোনও শ্রমিক-আন্দোলনের কর্মী ছিলাম না।
তারপর তারা ইহুদীদের ধরতে এসেছিল, এবং যথারীতি আমি কিছু বলি নি —
কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।
এরপর তারা একদিন আমাকে ধরতে এসেছিল — কিন্তু আমার পক্ষে কথা বলার মতো
তখন কেউই অবশিষ্ট ছিল না।
শেষ করছি এই বলে যে, অন্যায় সেটি যেখানেই হোক না কেন, আপনি যদি পাশে থাকেন অত্যাচারিতদের সঙ্গে থাকেন তাহলে তারাও আপনার পাশে থাকবে। যেকোন আন্দোলনের এইটাই মূল সুর। প্রতিবাদটাই আসল আন্দোলন, লুটপাটগুলো হলো গন্ডগোল।
আটলান্টা
৩রা জুন, ২০২০
No comments
Post a Comment